শুষ্ক মৌসুম শুরুর পর থেকে রাজধানী ঢাকায় ধুলার পরিমাণ মারাত্মকভাবে বেড়েছে। এ কারণে শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষ ঠাণ্ডা, কাশি, শ্বাসকষ্টসহ বহুবিধ রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, ধুলার কারণে রাজধানীর অনেক জায়গায় যানবাহন চালাচল করা কষ্টকর। পথচারীরাও নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারেন না। কিন্তু এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা দুই সিটি কর্পোরেশনের কার্যকর তৎপরতা নেই।
করোনা মহামারীর কারণে ঢাকায় এ বছর রুটিন উন্নয়ন কাজ কম হয়েছে। কিন্তু কয়েক মাস ধরে উন্নয়ন কাজের পরিমাণ বেড়েছে। পাশাপাশি চলছে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিআরটি, ওয়াসার পানি সরবরাহ লাইন নির্মাণ, ড্রেনেজ নির্মাণসহ নানাবিধ উন্নয়ন কাজ।
এসব কারণে বাতাসে ধুলার পরিমাণ বেড়েছে। পাশাপাশি পলিথিন, কাগজ, প্লাস্টিক পোড়ানোর কারণেও বায়ু দূষণ হচ্ছে। এই দূষণ প্রতিরোধের দায়িত্ব ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি), ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর।
দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে গাড়িতে করে পানি ছিটানোর তৎপরতা দেখা গেলেও তা ধুলা নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখতে পারছে না।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাছের খান যুগান্তরকে বলেন, ‘উন্নয়ন কাজ, সড়কে আবর্জনা ফেলা, প্লাস্টিক ও পলিথিন পোড়ানোর কারণে ধুলা দূষণের সৃষ্টি হচ্ছে।
ধুলা নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার পাশাপাশি নগরবাসীর সচেতনতাও দরকার। আমরা ইউরোপ, আমেরিকার মতো শহর চাই; কিন্তু নিজেরা কোনো বিধিবিধান মানতে রাজি নই। এভাবে তো ধুলা দূষণমুক্ত বাসযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব শহর গড়ে তোলা সম্ভব না। সবাইকে এ বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ধুলা দূষণের কারণে ঠাণ্ডা, কাশি, শ্বাসকষ্টসহ বহুবিধ রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর বিষয়টি অজানা নয়। তারপরও তারা কর্তব্য পালনে চরম অবহেলার পরিচয় দিয়ে চলেছে।’
সরেজমিন গিয়ে এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টঙ্গী থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত সড়কে বিআরটি’র নির্মাণকাজ চলছে। এ কারণে এই সড়কে ধুলা মারাত্মকভাবে বেড়েছে।
মাঝেমধ্যে ধুলার পরিমাণ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, পাঁচ-ছয় হাত সামনের গাড়ি দেখতে পান না চালকরা। এতে এক গাড়ির সঙ্গে অন্য গাড়ির ধাক্কা লাগার ঘটনাও ঘটছে।
টঙ্গীর বাসিন্দা তারিকুল ইসলাম বলেন, পেশাগত কাজে প্রতিদিন আমাকে যমুনা ফিউচার পার্কে আসা-যাওয়া করতে হয়। দিনের বেলায় উত্তরা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত সড়কে ধুলোর কারণে সামান্য দূরত্বের একটি বাস অন্য একটি বাসকে দেখতে পায় না।
দুই সপ্তাহ আগে উত্তরা আজমপুরে আমাকে বহনকারী বাসটি সামনের একটি বাসে ধাক্কা মেরে দেয়। সেদিন খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। কিন্তু ধুলা দূষণ প্রতিরোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।
কুড়িল প্রগতি সরণি সড়কও বেহাল। গভীর গর্ত করে উন্নয়ন কাজ চলছে। মাটি, বালু, ইট, সুরকি সড়কের পাশে রাখা হচ্ছে। এগুলোর ধুলা বাতাসে মিশে জনজীবন বিপর্যস্ত করছে।
মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের কারণে মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, শাহাবাগ, প্রেস ক্লাব, পল্টন, মতিঝিল এলাকা এখন ধুলোময়। ধুলার কারণে যানবাহন ও পথচারীদের চলাচল করা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।
ধুলা দূষণে ডিএসসিসির পক্ষ থেকে পানি ছিটানো হলেও সেটা তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। পানি ছিটানোর ৩০-৪০ মিনিট পর আগের অবস্থায় চলে আসে।
ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা, বাড্ডা, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এছাড়া মানুষের চলাচল, বাসাবাড়ির আবর্জনা, বেসরকারি উন্নয়ন কার্যক্রমের কারণেও শহরে মারাত্মকভাবে ধুলোবালির সৃষ্টি হচ্ছে।
হাজারীবাগের বাসিন্দা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ইমদাদুল হক বলেন, ‘ধুলোবালির মধ্য চলাচল করে শ্বাসকষ্ট হয়ে গেছে। এভাবে চললে অল্প বয়সেই মারা যাব। চেষ্টা করছি ঢাকা থেকে মফস্বলে বদলি হয়ে যেতে।’
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত ধুলার কারণে জামাকাপড় পরিষ্কার, বাসাবাড়ি ধোয়া ও মোছার জন্য অতিরিক্ত পানি ও ডিটারজেন্ট ব্যবহার করতে হয়।
কাপড় ইস্ত্রি করতেও অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচ করতে হয়। ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে ধুলা দূষণের কারণে মাসে অন্তত ৪ থেকে ১০ হাজার টাকা বেশি খরচ করতে হয়।
পবা’র গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সড়কে জমে থাকা ধুলোবালি চলন্ত বাসের গতিতে উপড়ে উঠে বাতাসে মিশছে। গ্যাস, পানি, স্যুয়ারেজ নানা কারণে সড়ক খনন করা হয়।
সেই মাটি সড়কের উপর স্তূপ করে রাখার কারণে ধুলোবালির সৃষ্টি হচ্ছে। দালানকোঠা বা অন্যান্য অবকাঠামোর নির্মাণসামগ্রী খোলা ট্রাক ও অন্যান্য বাহনে পরিবহন করা হচ্ছে। এতেও বাতাসে ধুলা ছড়াচ্ছে।
ডিএনসিসির সংশ্লিষ্টরা জানান, ধুলা দূষণ প্রতিরোধে ১০টি গাড়িতে করে নিয়মিত তারা পানি ছিটাচ্ছেন। তবে এটা প্রয়োজনের তুলনায় কম। গাড়ির সংখ্যা বাড়ানোর চিন্তা রয়েছে।
আর ডিএসসিসি’র সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিদিন তারা ৮টি গাড়িতে করে পানি ছিটাচ্ছেন। যেটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে কয়েকটি গাড়ি কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর মো. বদরুল আমিন বলেন, ‘বিদ্যমান সক্ষমতা দিয়ে আমরা ধুলা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে যাচ্ছি। পানি ছিটানোর গাড়ির সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোকেও ধুলা নিয়ন্ত্রণ করে কাজ করতে বলা হয়েছে। আমরা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। আশা করি ভালো ফল মিলবে।’
এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর এম সাইদুর রহমান বলেন, ‘ধুলা নিয়ন্ত্রণে গাড়িতে করে পানি ছিটানো হচ্ছে। এছাড়া ডিএনসিসি এলাকায় বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষকে ধুলা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে চিঠি দেয়া হয়েছে।’