'পথের বাপই বাপরে মনা/ পথের মা'ই মা/ এই পথের বুকেই খুঁজে পাবি/ আপন ঠিকানা।' গানটি বাজলেই চোখে ভাসে পথশিশুদের মুখচ্ছবি। নব্বই দশকে জেমস গানে গানে যেন ছুঁতে চেয়েছিলেন পথে থাকা শিশুদের কষ্টের রংগুলো। পথে জীবন কাটানো শিশুদের হাহাকার আছে এখনও। পথটাকে 'আপন ঠিকানা' মানলেও আদতে তারা ভালো নেই। নিজেদের দুরন্ত ফড়িং ভাবলেও তাদের হৃদয় আঙিনা বেদনায় ভরা, ছোট মনে কেবলই দুঃখের বসত। শিশুদের পথে নামার পেছনে আছে নতুন নতুন গল্প। কে মা, কে বাবা? কোথায় জন্ম, কোথায় ভিটে? এসব প্রশ্নের উত্তর অনেক পথশিশুরই অজানা। নিয়ন্ত্রণহীন চলাফেরায় এসব অবুঝ প্রাণ অজান্তেই দিয়েছে আঁধারে ডুব। কেউ কেউ হাঁটছে চুরি-ছিনতাই-বখাটেপনাসহ নানা অপরাধের গলিপথে। কারও হাত পেকেছে মাদক বেচাকেনায়। কেউ আবার মাদকের নেশায় বুঁদ।
রাজধানীর পথশিশুরা কেমন আছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অনুসন্ধানে নামে সমকাল। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ১০০ পথশিশুকে অনুসরণ করা হয় টানা দুই মাস (২৫ এপ্রিল থেকে ২৩ জুন)। চলে জরিপ। কমলাপুর রেলস্টেশন, গুলিস্তান, মতিঝিল, ফকিরাপুল, ভিক্টোরিয়া পার্ক, সোহরাওর্য়ার্দী পার্ক, খিলগাঁও রেলগেট, খিলগাঁও তালতলা, মালিবাগ, তেজগাঁও রেলস্টেশন, ফার্মগেট, শ্যামলী, মাজার রোড, গাবতলী এবং বিমানবন্দর রেলস্টেশনে গিয়ে এক-এক করে কথা হয় শত শিশুর সঙ্গে; যাদের সবার বয়স ১৮ বছরের নিচে। অনুসন্ধানেই উঠে আসে পথশিশুদের জীবনের বিষাদময় ছবি।পথশিশুদের কারও মা, কারও বাবা অন্যত্র বিয়ে করে পেতেছে নতুন সংসার। আবার কারও মা-বাবা থাকলেও নেই যোগাযোগ। পারিবারিক সম্পর্কে টানাপোড়েন, মা-বাবার বিচ্ছেদ, দারিদ্র্য, অযতœ-অবহেলা, মাদকে জড়িয়ে পড়াসহ নানা কারণেই তারা আজ বোহেমিয়ান।
২০০৪ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সারাদেশে রয়েছে ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৮ পথশিশু। এর মধ্যে ঢাকাতেই থাকে ২ লাখ ৪৯ হাজার ২০০।সমকাল জরিপ চালিয়ে দেখেছে, রাজধানীর রাস্তায় থাকা ৭৯ শতাংশ পথশিশুই মাদকাসক্ত। ৭০ শতাংশ পথশিশু পায় না তিনবেলা খাবার। জন্মপরিচয় জানে না এমন শিশু ৬ শতাংশ। ৫৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলেও চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। বিভিন্ন সময় নানা কারণে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ৪৭ শতাংশ। রাস্তায় বাস করলেও ৬২ শতাংশ শিশু স্বপ্ন পোষে মনে। বড় হয়ে কী করবে- সেটাও ভাবে তারা। ৫৭ শতাংশ পথশিশু রাস্তাকেই মনে করে 'সুন্দর' জীবন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আর চায় না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়নি ৭৬ শতাংশ শিশু। ৩৪ শতাংশ শিশু কোনো কাজই করে না, তারা পুরোপুরি নির্ভর ভিক্ষার ওপর। মাঝেমধ্যে দোকানে পানি সরবরাহ ও স্টেশনে যাত্রীদের ব্যাগ-ব্যাগেজ টানাসহ নানা কাজে লেগে আছে ৩৫ শতাংশ পথশিশু।
জরিপে আরও বেরিয়ে এসেছে, ৩৮ শতাংশ শিশুর কারও মা নেই, আবার কারও নেই বাবা। এর মধ্যে মা-বাবা দু'জনই পৃথিবীতে নেই ১০ শতাংশ শিশুর। রাস্তায় বাস করলেও শিশুদের কেউ কেউ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগটা রাখে। আবার কেউ একেবারেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। এ রকম শিশু ৩৭ শতাংশ। জন্মের পর মা-বাবার সঙ্গে ছিল; এখন তারা কোথায় থাকে- জানে না ১০ শতাংশ পথশিশু। ২১ শতাংশ শিশুর মা-বাবার বিচ্ছেদ ঘটেনি, তবে ওই সব শিশু নানা কারণে পথকে বানিয়েছে ঠিকানা। এ ছাড়া রাজধানীতে সরকারি-বেসরকারিভাবে পরিচালিত পথশিশুদের জন্য গড়ে ওঠা শেল্টার হোমগুলোতে কিছুদিনের জন্য থেকেছে ৭০ শতাংশ পথশিশু।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পথশিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়ে কারও নজর নেই। অধিকাংশ পথশিশু শেষ হয়ে যাচ্ছে মাদকে। এসবের দায় রাষ্ট্রের। এখনও রাষ্ট্র এসব শিশুকে নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারেনি।তবে সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পথশিশুদের নিয়ে আলাদা সমন্বিত সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এখন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে কমলাপুর ও কারওয়ান বাজারে পথশিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। এ দুই কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ১৬০ শিশুর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সুরক্ষার লক্ষ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে কয়েকটি প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর পথশিশুদের বর্তমান পরিসংখ্যান ও পরিস্থিতি নিরূপণে ইউনিসেফের আর্থিক সহায়তায় বিআইডিএসের মাধ্যমে একটি জরিপ কার্যক্রম চালাচ্ছে।পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পথশিশুদের নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে। 'মজার ইশকুল' নামে একটি প্রতিষ্ঠান রাজধানীর ছয়টি উন্মুক্ত স্থানে সপ্তাহে এক দিন পথশিশুদের পড়ালেখা করায়। এটির উদ্যোক্তা আরিয়ান আরিফ বলেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে পথশিশুদের পড়ালেখা করান। সপ্তাহে এক দিন এক ঘণ্টা করে ছয়টি স্থানে পড়ানো হয়। সেখানে শিশুদের খাবারও দেওয়া হয়।
সঙ্গদোষে সর্বনাশ: উদ্বেগজনক খবর হলো- মাদক সেবনে জড়িয়ে পড়ছে পথশিশুরা। মাদক কারবারিরা মাদক বহনে বা বেচাকেনায় এসব শিশুকে ব্যবহার করছে। অনুসন্ধানে মিলেছে, ৭৯ শতাংশ পথশিশু মাদকাসক্ত। তাদের মধ্যে ড্যান্ডি সেবন করে ৫৬ শতাংশ শিশু আর গাঁজায় ফুঁক দেয় ১৮ শতাংশ। ড্যান্ডি ও গাঁজা দুটোতেই মজে থাকে ৫ শতাংশ পথের শিশু।গত ২৪ মে দুপুরে টিটিপাড়ায় শিশু সাইদ জানায়, মা-বাবা ফেলে চলে যাওয়ায় সে সিরাজগঞ্জের নানিবাড়ি থেকে ঢাকায় চলে আসে। কমলাপুর স্টেশনে থাকার কয়েক মাস পর এক মাদক কারবারি তাকে গাঁজা বিক্রিতে লাগায়। সেখান থেকে সেও গাঁজা সেবন শুাং করে।শিশুরা জানিয়েছে, তারা প্রত্যেকেই একে অপরের সংস্পর্শে এসে মাদক সেবন শুরু করেছে। প্রায় প্রত্যেকের মাদক সেবনের আগে শুাং ধূমপান। এরপর বিভিন্ন মাদকে জড়িয়ে পড়ে।
কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের চিফ কনসালট্যান্ট ও সহযোগী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি) ডা. শোয়েবুর রেজা চৌধুরী বলেন, অল্প বয়সে মাদক সেবন করলে শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। ফলে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার শঙ্কা থাকে।মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, ড্যান্ডি এক ধরনের আঠা। এটি বিভিন্ন ধরনের চামড়াজাত দ্রব্য এবং প্লাস্টিক পণ্য জোড়া লাগাতে ব্যবহার হয়। এ ছাড়া মারণাস্ত্র ডিনামাইট প্রস্তুতে ব্যবহূত হয় এই আঠা। এটি পলিথিনে ঢুকিয়ে ফুঁ দিলে ভেতরে টলুইন নিঃসৃত হয়, যা নাক-মুখ দিয়ে টানে শিশুরা। শ্বাসতন্ত্রে গিয়ে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসকে বাধাগ্রস্থ করার পাশাপাশি এক ধরনের মাদকতা তৈরি করে। ড্যান্ডি 'সলিউশন' নামেও পরিচিত। ফত কৌটার দাম ৫০ থেকে ১০০ টাকা। সাইকেল-রিকশা-ভ্যানের টিউব টায়ারে দোকান থেকে সহজেই সংগ্রহ করতে পারে শিশুরা।
এদিকে,অতিরিক্ত ড্যান্ডি সেবনের কারণে দুই পথশিশুর মৃত্যুর তথ্য মিলেছে অনুসন্ধানে। অতিরিক্ত ড্যান্ডি সেবনের কারণে ছয় বছর আগে বরিশালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এক শিশুর মৃত্যু হয়। একই কারণে গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজধানীর টিটিপাড়ায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় আরেক শিশু।মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. রাশেদুজ্জামান বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন মহল্লার দোকানিকে নিষেধ করা হয়, তারা যাতে শিশুদের কাছে সলিউশনের কৌটা বিক্রি না করে। তারপরও কেউ মানে কেউ মানে না।
জন্মপরিচয় জানে না ৬ শতাংশ শিশু: বয়স কত- তা নিশ্চিতভাবে জানে না শিশু রাতুল। জানার কথাও নয়। কারণ, শিশু যখন বুঝতে শিখে, তখন নিজের বয়স সম্পর্কে প্রথম জানতে পারে মা-বাবার কাছ থেকে। ভালো কাজে উৎসাহ এবং মন্দ কাজে নিষেধাজ্ঞা আসে পরিবার থেকে। সে সুযোগ হয়নি তার। বোঝার পর নিজেকে আবিস্কার করে কমলাপুর রেলস্টেশনে; অন্য শিশুদের মধ্যে। তার এখন বয়স ১০ থেকে ১২।
রাতুল একা নয়, রাজধানীর ৬ শতাংশ শিশু তাদের জন্মপরিচয় জানে না। গত ২০ মে রাত পৌনে ২টার দিকে সবুজবাগ ফ্লাইওভারে কথা হয় ১৬ বছরের ইমনের সঙ্গে। সে বলল, 'বুদ্ধি হওয়ার পর নিজেকে দেখতাছি কমলাপুর স্টেশনে। মা-বাবা আছে কিনা, জানতে পারি নাই। রাস্তয় বড় হইছি। যখন বুঝবার শিখছি, তহন আমার মতো যারা রাস্তায় থাকে, তাগোর জিগাইছি- আমার জন্মপরিচয় কী। আব্বা-মা আছে কিনা। কেউ কইতে পারে নাই। সবার জন্মপরিচয় থাকে। আমার নাই। একেবারেই একা! আপন বলতে কেউ নাই আমার!'ইব্রাহিম নামের এক শিশু বড় হয়েছে সায়েদাবাদ এলাকার একটি বাসায়; গৃহকর্তা ফিরোজ ও গৃহকর্ত্রী আফিয়ার কাছে। এখন তার বয়স ১৫। গত ২৮ মে খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে ইব্রাহিম জানায়, ওই গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী তাকে জানিয়েছে- ছোট্টবেলায় তাকে খাগড়াছড়ি থেকে তাঁরা নিয়ে এসেছেস। তার মা-বাবা নেই। ৮ মে কমলাপুর রেলস্টেশনে ১১-১২ বছরের হৃদয় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানায়, কমলাপুর, বিমানবন্দর ও টঙ্গী রেলস্টেশনকেই এখন সে ঘরবাড়ি মনে করে। তার প্রশ্ন- কেন তাকে রাস্তায় বড় হতে হচ্ছে। এ দায় কার!জন্মের পর বাবাকে দেখেনি ১৫ শতাংশ পথশিশু: জন্মের পর মাকে দেখলেও ১৫ শতাংশ পথশিশু বাবাকে দেখেনি। তাদের মধ্যে ১০ শতাংশ শিশু মা কিংবা স্বজনদের কাছ থেকে জেনেছে, জন্মের আগেই মা-বাবা মারা গেছে। তবে পাঁচ শিশু তাদের পিতৃপরিচয় সম্পর্কে কারও কাছে কোনো তথ্য পায়নি। বাবার নামটিও বলতে পারেনি তারা। সবুজবাগ এলাকায় গত ২০ মে রাত পৌনে ১টার দিকে ১৩ বছরের শিশু সাগর জানায়, জন্মের পর বাবাকে দেখেনি সে। যখন বুঝতে শিখেছে, তখন দেখে মায়ের সঙ্গে কমলাপুর রেলস্টেশনে। মায়ের কাছ থেকে বাবা সম্পর্কে কোনো তথ্য পায়নি সে। নামটিও জানে না। তাকে ছেড়ে চলে গেছে মাও। ২৫ মে রাতে বিমানবন্দর রেলস্টেশনে ১১ বছরের শিশু আমির বলল, 'আব্বা কে, জানি না। আছে কিনা তা-ও জানি না।'
'খিদা পাইলে কুড়াইয়া খাই': ৭০ শতাংশ পথশিশু পায় না তিনবেলা খাবার। বাকি ৩০ শতাংশ যে কোনোভাবে নিজের খাবারটা জোগাড় করে নেয়। গত ১১ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১১ বছর বয়সী পথশিশু সাগর বলে, 'বাবা নেই। মা ময়মনসিংহে ভিক্ষা করে। নতুন বিয়ে করেছে। আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। খাবারের ঠিক নাই। প্রতিবেলা খাবারে টাকা পাব কোথায়? কেউ দিলে খাই। টাকা থাকলে একবেলা কিনে খাই।' ১৬ মে দুপুরে শ্যামলী শিশু পার্কের সামনে ১৪ বছরের শিশু শাকিল বলে, 'ঠিকমতো খাবার পামু কই! মানুষ ভিক্ষা দিতে চায় না। খুব খিদা পাইলে মানুষের ফালাইয়া দেওয়া খাবার কুড়াইয়া খাই।'৪৩ শতাংশ শিশু জানে, তাদের মা-বাবা পেতেছে নতুন সংসার :৪৩ শতাংশ শিশুর কারও বাবা কিংবা কারও মা অন্যত্র বিয়ে করে সংসার করছে। এদের মধ্যে ৫ শতাংশ শিশুর মা-বাবা দু'জনই তালাক দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। বিয়ের পর সন্তাানদের ফেলে রেখে গেছেন তাঁরা। শিশু জাহিদ গত ৮ মে কমলাপুর রেলস্টেশনে আলাপকালে বলে, 'মা নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় গেঞ্জি কারখানায় চাকরি করত। আব্বা বাবুর্চি ছিল। গাঁজা খাইত। সংসারে শান্তি ছিল না। বাবা বিয়া কইরা চলে যায়। মাও আরেকটি বিয়া বসছে। সৎবাবারে ভালো লাগে নাই। তাই সাত বছর আগে বাসা থেকে বের হইছি। তারা দু''জন শান্তি খুঁজে নিছে। আমার শান্তি তারা দেখেনি। তাই আমি রাস্তায় শান্তি খুঁজে নিয়েছি।'
২৮ মে খিলগাঁও তালতলা মার্কেট এলাকায় শিশু আতিকুল বলে, 'পাঁচ বছর বয়সে আমাকে নরসিংদীতে নানির কাছে রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করে চলে যায় মা। পরে বাবাও আরেকটি বিয়ে করে নিরুদ্দেশ। এখন মা-বাবার খোঁজ জানি না।' সে বলল, 'নানি গরিব মানুষ। মা-বাবা যখন রাখেনি, তখন নানির কাছে ক্যান থাকব! তাই ট্রেনে উইঠ্যা কমলাপুরে চলে আইছিলাম। রাস্তাতেও ভালো নাই। ভালো কাপড়চোপড় পাই না। খাওয়ার ঠিক নাই।'২৪ শতাংশ পথশিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেলেও পরে রাস্তায় চলে আসে :রাজধানীর ২৪ শতাংশ পথশিশু পরিবারের সঙ্গে বাড়িতে থাকার সময় স্কুল কিংবা মাদ্রাসায় গেছে। পরে দারিদ্র্যসহ নানা কারণে পড়ালেখা ফেলে পালিয়ে আসে রাস্তায়। অবশ্য নিজের নাম লিখতে পারে ৭৮ শতাংশ শিশু। রাজধানীর বিভিন্ন পথস্কুলে নাম লেখা শিখেছে তারা। তবে ২২ শতাংশ শিশু নাম লিখতে-পড়তে কিছুই পারে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পালিয়ে আসা সত শিশুর এক শিশুর নাম তরিকুল ইসলাম। বয়স ১৩। গত ৩১ মে রাত ১১টার দিকে বিমানবন্দর রেলস্টেশনে কথা হয় তার সঙ্গে। বলল, প্রথমে মাদ্রাসায় পড়তে দিয়েছিল। সেখানে ভাল্লাগেনি। পরে স্কুলে পাঠাই। সেখানে যাইতে ডর লাগে। তাই এক দিন ট্রেনে উইঠা ঢাকায় চলে আইছি।'সাইকেল, ফোন পেয়েও মন টেকেনি: তরিকুল ইসলাম বেশ সচ্ছল পরিবারের সন্তান। বাবা থাকেন বিদেশে। মা ও তিন ভাই থাকেন কিশোরগঞ্জে। মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান তরিকুলকে প্রথমে মাদ্রাসা ও পরে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়েছিল পরিবার। পড়ালেখা করতে ভালো লাগেনি তার। প্রথম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় পালিয়ে আসে ঢাকায়।সে বলে, 'বাড়ি ছেড়ে আসার পর মায়ের কথা মনে হতো প্রতিদিন। কিছুদিন পর মাকে দেখতে বাড়ি যাই। যাতে আর ঢাকায় চলে আসতে না পারি, সে জন্য শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। মা-বাবা আমাকে সাইকেল ও মোবাইল ফোনও কিনে দিয়েছিল। তারপরও ছাড়া পেয়ে আবার চলে আসি রাস্তায়। তরিকুল বলে, 'মাঝেমধ্যে মাকে দেখতে খুব মন চায়। তখন গ্রামে যাই। তবে বাড়ির মধ্যে যাই না। গেলে মা আবার আটকে ফেলবে আমাকে। বাড়ির কাছে গাছের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। মা বাইরে এলে দেখে চলে আসি।'
জন্মনিবন্ধনের বাইরে থেকে যাচ্ছে পথশিশুরা: দেশের সব মানুষের জন্মনিবন্ধন সরকার বাধ্যতামূলক করলেও পথশিশুদের ক্ষেত্রে তা করা হচ্ছে না। নানা জটিলতায় আটকে আছে তাদের জন্মনিবন্ধন। অবশ্য তাদের জন্মনিবন্ধন সনদ নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে- তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। তিন মাসের মধ্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব এবং জন্মনিবন্ধন অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্নিষ্টদের এ বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। একটি রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ৩০ জুন হাইকোর্ট এ আদেশ দেন।এ ব্যাপারে স্ট্রিট চিলড্রেন অ্যাক্টিভিস্টস নেটওয়ার্ক' (স্ক্যান)-এর সভাপতি জাহাঙ্গীর নাকির বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে পথশিশুর সংখ্যা নিরূপণ করা হচ্ছে না। অনেকে মা-বাবার নাম কিংবা ঠিকানা ঠিকমতো বলতে পারে না। বর্তমানে জন্মনিবন্ধন করতে মা-বাবার জন্মসনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র লাগে, যেটা তাদের পক্ষে উপস্থাপন করা সম্ভব হয় না। তাদের বিশেষ প্রক্রিয়ায় জন্মনিবন্ধনের আওতায় আনা জরুরি। এসব শিশুর প্রকৃত সংখ্যা না জানলে তাদের জন্য সঠিক পরিকল্পনা করা যাবে না। সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া পথশিশুদের সমস্যা সমাধান কঠিন।'
কারা, কী বলছেন: সমাজবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, 'মাঝেমধ্যে পথশিশুদের জন্য হুট করে পরিকল্পনাহীন উদ্যোগ নেওয়া হয়। হঠাৎ হঠাৎ এসব উদ্যোগে তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা সুরক্ষা হবে না। রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি সমাজের দানশীলদেরও আসা উচিত বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে।'
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, 'পথশিশুদের যথাযথ দেখভাল না করলে তারা আরও বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। কারণ, তাদের থাকার জায়গা নেই। খাওয়ার বন্দোবস্ত নেই। রাস্তাায় থাকে, রাস্তায় ঘুমায়। এতে বিভিন্ন ধরনের অপরাধীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক হয়। ছোটখাটো অপরাধ করা শিখতে শিখতে বড় হয়ে সন্ত্রাসীদের খাতায় নাম লেখাচ্ছে। পথশিশুদের সুরক্ষা রাখতে সম্মিলিত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।' তিনি আরও বলেন, 'আবাসন ও লেখাপড়া করার সুযোগ করে দেওয়ার পাশাপাশি হাতের কাজ শেখানো দরকার। মাদকাসক্ত শিশুদের চিকিৎসা করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। এসব ব্যবস্থা না নিলে একসময় তারা ঢাকাবাসীর জন্য কিংবা পুলিশের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।'সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, 'শুধু পথশিশুদের জন্য আমাদের আলাদা কোনো ইনস্টিটিউট নেই। তবে পথশিশুদের পুলিশ কিংবা কেউ ধরে দিলে শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র, দুস্থ শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং সরকারি শিশু পরিবারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লালনপালনের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া ইউনিসেফের অর্থায়নে সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় সিএসপিবি নামে পথশিশুদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে একটি প্রকল্প চলমান আছে।'
[সামাজিক নিরাপত্তার স্বার্থে পথশিশুদের কারও প্রকৃত নাম ব্যবহার করা হয়নি)