করোনা মহামারির মধ্যে দেশে বিভিন্ন এনজিও ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহিতাদের কাছ থেকে কিস্তির টাকা আদায়ে চাপ সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সরকারের পক্ষ থেকে এই দুর্যোগে কিস্তি আদায়ে কোন চাপ না দেয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহিতাদের অনেকে অভিযোগ করেছেন, তাদের কিস্তির টাকার জন্য আগের মতোই প্রতিসপ্তাহে তাগাদা দিচ্ছেন এনজিও কর্মিরা।
তবে কিস্তির টাকা আদায়ে ঋণ গ্রহিতাদের চাপ সৃষ্টির অভিযোগ অস্বীকার করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওগুলো।
দুটি আঞ্চলিক এনজিও-এর কাছ থেকে দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে কৃষি জমি কিনেছিলেন উত্তরের জেলা বগুড়ার শাজাহানপুর এলাকার একজন গৃহিনী মহিমা বেগম। পাঁচ মাস তিনি নিয়মিত প্রতি সপ্তাহে কিস্তির টাকা দিয়ে এসেছেন। কিন্তু করোনা মহামারি শুরু হলে অর্থ সংকটে পড়েন তিনি।
মহিমা বেগম বলছেন, তাঁর অর্থসংকট এবং মহামারি কিছুই বুঝতে চাচ্ছেন না এনজিও-এর লোকজন। তিনি বলেন, 'হামরা কছি যে, তিন মাস লকডাউন দিচে, আপনে ট্যাকার চাপ দ্যান ক্যা? হামি বলতেছি যে, হামার স্বামী বাইরে আছে দিবার পারতেছে না। এরা শোনেই না। হামি তারপর বলছি যে, আপনে কি কিস্তির জন্যে গলাত দড়ি দিবার কচ্ছেন হামাক? কয় না না গলাত দড়ি দেবেন ক্যা, আপনি চেষ্টা করেন। তো চেষ্টা করলে কোটে পাওয়া যায় কন। এই মুহূর্তে কাম করলেই মানুষ ট্যাকা পাচ্ছে না।'
রংপুর জেলার সৈয়দপুরের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে অল্প বেতনে চাকরি করেন এম হাসান। তিনি দুটি স্থানীয় এনজিও-এর কাছ থেকে দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন বিপদে পড়ে। তিনি জানান, এখন কিস্তির টাকার জন্য এনজিও কর্মিরা যেভাবে তাগাদা দিচ্ছেন, তাতে তাঁর বিপদ আরো বেড়েছে।
এম হাসান বলেন, 'রোড অ্যাক্সিডেন্ট করার পর আমি সুদের ওপর কিছু মানুষের কাছ থেকে টাকা নেই। এই টাকাটা শোধ করতে গিয়ে আমি এনজিও'র দ্বারস্থ হই। দুটা এনজিও থেকে দুই লক্ষ টাকা নিয়েছিলাম। এই টাকায় আমার প্রতিমাসে কিস্তি ছিল ২১ হাজার টাকার মতো। এখন সপ্তাহে সপ্তাহে তারা ফোন দিয়ে হুমকি দিচ্ছে, কিস্তি না দিলে মামলা করবে এবং বিভিন্ন ব্যবস্থা নেবে।'
এম হাসান আরো বলেন, 'এখন মনে হচ্ছে, পালিয়ে বাঁচতে পারলে ভালো হয়, তাওতো পরবো না। পালিয়ে বাঁচারওতো সুযোগ নাই আমাদের।'
করোনা দুর্যোগের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আঘাতে যে এলাকার মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সুন্দরবন লাগোয়া সাতক্ষীরা জেলার সেই শ্যামনগর এলাকার একজন গৃহিনী প্রতিমা রাণী মিস্ত্রী। তিনি বলেন, কিস্তির টাকার জন্য তাদের চাপ দিচ্ছে না। তবে প্রতিসপ্তাহে এনজিও-এর কর্মিরা এসে কিস্তির কথা মনে করিয়ে দেন বলে জানান তিনি।
প্রতিমা রাণী বলেন, 'মাছ চাষের জন্য ঋণ নিছিলাম। প্রতিসপ্তাহে তারা আসতেছে এবং বলতেছে, আমাদের বাকিটা দেন। তারা খুব চাপ দিচ্ছে না। কিন্তু চাচ্ছে আর কি।'
ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণকারী এনজিওগুলোর একটি ফোরামের কর্মকর্তা এবং টিএমএসএস নামের এনজিও-এর নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা বেগম বলেন, এনজিও কর্মিরা গ্রামে গ্রামে ঋণ গ্রহিতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। কিন্তু কোনো চাপ দেন না বলে দাবি করেন তিনি।
হোসনে আরা বেগম বলেন, 'মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির নিবন্ধিত কোনো সংগঠন গ্রামে কিস্তি আদায়ে মূলত যায় না এবং চাপও দেয় না। আর সরকারের নির্দেশ রয়েছে যে চাপ দেওয়া যাবে না। যারা স্বেচ্ছ্বায় দেবে, সেটা সংগ্রহ করতে হবে। সেটাই আবার অন্য একজন যদি কিছু করতে চায়, তাকে দিতে হবে। গ্রামপর্যায়ে যাতে মানি সার্কুলেশন থাকে। আমরা সেটাই করছি।'
সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএস-এর ড. নাজনীন আহমেদ মনে করেন, ছোট এনজিওগুলোর জন্য অর্থসহায়তার ব্যবস্থা না করলে ঋণ গ্রহিতাদের কিস্তি আদায়ে চাপ বন্ধ করা মুশকিল।
ড. নাজনীন বলেন, 'বিদেশি সাহায্যনির্ভর এনজিওগুলো বা বড় এনজিও যাদের কমার্শিয়াল অপারেশন আছে, তারা একটু ভালো অবস্থায় আছে। কিন্তু যে এনজিওগুলো স্থায়ী ফান্ড দিয়ে চলে, তাদের শুধু বলে দিলে লাভ হবে না যে, আপনি টাকা আদায় করবেন না। এই ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচানোর জন্যও কাউন্টার সাপোর্ট পদ্ধতি থাকতে হবে।'
সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ বলেন, গ্রামের ঋণ গ্রহিতাদের ওপর চাপ কমাতে ছোট এনজিওগুলোর অর্থ সহায়তার বিষয়েও তারা চিন্তা করছেন। তিনি বলেন, 'গ্রামে ঋণ গ্রহিতাদের কিস্তি আদায় যেন চাপ দেওয়া না হয়, সেটা তদারকি করা হচ্ছে। এছাড়া ছোট এনজিওগুলোকেও সহায়তার বিষয়ে চিন্তা করা হচ্ছে।'
এনজিওদের ফোরামের হিসাব অনুযায়ী, দেশে চাষাবাদ করা থেকে শুরু করে ব্যবসাসহ বিভিন্ন কাজের জন্য এবছর তিন কোটির বেশি পরিবার ক্ষুদ্র ঋণ নিয়েছেন।
সূত্র : বিবিসি বাংলা।