বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১

কক্সবাজারের রেল যোগাযোগ খুলে দেবে সমুদ্র অর্থনীতির নতুন জানালা

প্রকাশিত: ০৯:১১ এএম, নভেম্বর ১০, ২০২৩

কক্সবাজারের রেল যোগাযোগ খুলে দেবে সমুদ্র অর্থনীতির নতুন জানালা

মাহমুদা আক্তার খানম: কক্সবাজারের রেল যোগাযোগ খুলে দেবে সমুদ্র অর্থনীতির নতুন জানালা। বঙ্গবন্ধুর কন্যার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতধওে এই দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন আজ বাস্তবায়ন হলো। এরমধ্যে দিয়ে সারাদেশের সঙ্গে কক্সবাজারের রেল যোগাযোগ স্থাপন। একসময় ছিল স্বপ্ন। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পর্যটনে সুবাতাস বয়ে আনার পাশাপাশি বহুমাত্রিক অর্থনীতির জানালা খুলে গেল। বিনিয়োগ বাড়বে পর্যটন, কৃষি ও চিংড়ি শিল্পে। গতি পাবে শিল্পে পিছিয়ে পরা এ অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা। এ কারণে আনন্দে উচ্ছ্বসিত কক্সবাজারের মানুষ। সৈকত পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারিত হওয়ায় জেলায় উৎপাদিত পণ্য কম মূল্যে যেমন পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হলো, তেমনি পর্যটক আগমনও বেড়ে যাবে কয়েক গুণ। তবে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।কক্সবাজার শহর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজীপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে এই আইকনিক রেলস্টেশন। ঝিনুকের আদলে তৈরি দৃষ্টিনন্দন এ স্টেশন ভবনটির আয়তন ১ লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয়তলা ভবনটির কাজ প্রায় শেষ। ঝিনুকের আদলে তৈরি স্টেশনটিতে আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি ক্যান্টিন, লকার, গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। পর্যটকরা স্টেশনের লকারে লাগেজ রেখে সারাদিন সমুদ্রসৈকতে বা দর্শনীয় স্থানে ঘুরে আবার রাতের ট্রেনেই ঢাকায় ফিরতে পারবেন। এ স্টেশন দিয়ে দিনে ৪৬ হাজার মানুষ আসা-যাওয়া করতে পারবে। প্রকল্প পরিচালক সুবক্তগীন সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ‘স্টেশনটি নির্মাণে চীন, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। পুরো প্রকল্পটিতে ১১০ বিদেশিসহ মোট ২৫০ প্রকৌশলী এবং ছয় শতাধিক লোক কাজ করছে। চার বছরের মেধা-শ্রমে আইকনিক রেলস্টেশন ভবনটি আজ দৃশ্যমান। এখন সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে।’ তিনি বলেন, ‘এটি হবে এশিয়ার প্রথম শতভাগ পর্যটনবান্ধব কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছয়তলার স্টেশন। এতে রয়েছে পর্যটকের জন্য সব সুযোগ-সুবিধা। থাকছে আধুনিক ট্রাফিক সুবিধা। স্টেশনের নিচতলায় থাকছে টিকিট কাউন্টার, অভ্যর্থনা কেন্দ্র। দ্বিতীয় তলায় শপিংমল ও রেস্তোরাঁ। তিনতলায় থাকবে তারকা মানের হোটেল। থাকছে মসজিদ, শিশু যতœ কেন্দ্র, এটিএম বুথ, পোস্ট অফিস, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথসহ নানা সেবাকেন্দ্র।পর্যটন তথ্য সুত্রে জানা যায়,চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কপথের দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। সড়কপথে বাসে যেতে সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টা। আর এ মহাসড়কে যানজটে পড়লে পেরিয়ে যায় ছয়-সাত ঘণ্টা। এ রেলপথ চালু হওয়ার পর ছয়-সাত ঘণ্টার এ দূরত্ব নেমে আসবে অর্ধেকে; কমবে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকিও। আর অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতি আসার পাশাপাশি সুযোগ সৃষ্টি হবে বহুমাত্রিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের। পর্যটনের পর কক্সবাজারের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কয়েকটি খাত হলো লবণ, কৃষিপণ্য, মৎস্য ও শুঁটকি। এসব পণ্য কম খরচে আনা-নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। কৃষিপণ্য সহজে আনা-নেওয়ার সুবিধা থাকলে কৃষকেরও দাম পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যেও কিছুটা গতি আনতে পারে নতুন এ রেলপথ। কক্সবাজার সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের পর্যটন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মঈনুল হাসান পলাশ বলেন, ‘সস্তায় আসা যাওয়া-সস্তায় থাকা খাওয়া’ এটি পর্যটন বিকাশের মন্ত্র। এখন সড়কপথে কক্সবাজারে আসতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। রেল চালু হলে যাতায়াত আরও সহজ হবে। কক্সবাজারের হোটেল মোটেল গেস্টহাউসের একাধিক মালিক বলেন, সমুদ্রসৈকত দেখার জন্য প্রতিবছর অন্তত ১৬ লাখ পর্যটক কক্সবাজার আসেন। রেলপথ চালু হলে এর সংখ্যা তিন গুণ বেড়ে যাবে। তখন পর্যটন খাতে উন্নতির পাশাপাশি রেল খাতেও সরকারের কোটি কোটি টাকা আয় হবে।ব্যবসায়ীরা মনে করেন রেল চালু হলে পর্যটক যাতায়াত সহজ হওয়ার পাশাপাশি স্বল্প সময়ে ও কম খরচে কৃষিপণ্য, মাছ, লবণ পরিবহন করা যাবে। এতে কক্সবাজারের পর্যটনসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে আসবে বৈপ¦লিক বদল। কক্সবাজার উপকূলে স্থাপিত ৫৭টি হ্যাচারিতে প্রায় এক হাজার কোটির উপরে চিংড়ি পোনা উৎপন্ন হয়। উৎপাদিত এ পোনা দিয়ে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের তিন লাখ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। ট্রাকে সরবরাহ করতে গিয়ে অক্সিজেনের সংকটে পড়ে প্রচুর পোনা মারা যায়। এ কারণে কার্গো বিমানে পোনা সরবরাহ করতে হচ্ছে। এতে পরিবহন খাতে বিপুল টাকা খরচ হচ্ছে। রেলপথ চালু হলে কম ভাড়ায় পোনা সরবরাহ করা যাবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়,শুরুতে এটি ছিল ‘দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ’ প্রকল্প। এতে মোট ১২৯ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কথা ছিল। পরে রামু থেকে ঘুমধুম অংশের কাজ স্থগিত করা হয়। এখন চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। মোট ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। বাকি ৪ হাজার ১১৯ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে। প্রকল্পের জন্য কক্সবাজারে ১ হাজার ৩৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে ৯টি রেলওয়ে স্টেশন, চারটি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু, ১৪৯টি বক্স কালভার্ট এবং ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট। প্রকল্প সুত্র জানায় এই রেলপথ ক´বাজারই সীবাবদ্ধ থাকবে না। আগামীতে মায়ানমার হয়ে চিনের কুনমিনের সাথে সংযুক্ত হয়ে তুরস্কের সাথে সংযুক্ত থাকবে।
Link copied!