এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের দায়িত্বে বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান, ঢাকায় পাওয়ারকোতে মাত্র ৩ জন কর্মচারী
প্রকাশিত: ০৪:৩৪ এএম, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২১
ডেইলি খবর ডেস্ক: দেশের বৃহত্তম গভীর সমুদ্র তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) টার্মিনাল তৈরির জন্য তিনটি সংস্থার কনসোর্টিয়ামকে চুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। তবে কনসোর্টিয়ামের তিনটি প্রতিষ্ঠানের দুটিরই বিতর্কিত ইতিহাস রয়েছে।
মহেশখালীতে মিলিয়ান-টন ক্ষমতাসম্পন্ন এলপিজি টার্মিনাল তৈরির চুক্তি প্রাপ্ত কনসোর্টিয়ামের অংশীদার সুইস ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান ভিটল। সুত্রগুলো জানায় ব্রাজিলিয়ান কর্মকর্তাদের ব্যবসায়িক লাভের জন্য ঘুষ দেওয়ার কারণে গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটিকে ১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার জরিমানা করে। কনসোর্টিয়ামের বাংলাদেশি শেয়ার হোল্ডার পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল; সিঙ্গাপুরের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড কর্পোরেট রেগুলেটরি অথোরিটির(এসিআরএ)তালিকাভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১০০ ডলার। কনসোর্টিয়ামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান হল জাপানের দ্য মারুবেনি করপোরেশন। যুক্তরাষ্ট্রের ইস্টার্ন ডিস্ট্রিক্ট অব নিউইয়র্কের ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি সেথ ডুচারমে এক বিবৃতিতে বলেছিলেন,আকর্ষণীয় ব্যবসায়িক চুক্তি পেতে ও প্রতিদ্বন্ধিতামূলক ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকতে ব্রাজিল,ইকুয়েডর ও মেক্সিকোর সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়েছে ভিটল।" বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান পাওয়ারকো এসিআরএ-তে জানিয়েছে,প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যক্রম হল ব্যবস্থাপনা পরামর্শ পরিষেবা এবং বিভিন্ন পণ্যের পাইকারি বাণিজ্য। সেখানে মো: কামরুজ্জামান চৌধুরী এবং নাবিল খানকে এর শেয়ারহোল্ডার হিসেবে দেখানো হয়েছিল। জানা গেছে ভিটল-মারুবেনি-পাওয়াারকো কনসোর্টিয়াম ৩০৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে মহেশখালী এলপিজি টার্মিনাল তৈরি করবে এবং প্রকল্পের কাজে ৪৭ একর জমি বরাদ্দ দেওয়ার জন্য বিপিসিকে ৩০ শতাংশ শেয়ার দেবে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ জানিয়েছে, জাপানের মিতসুইয়ের দুই অংশীদার এবং দক্ষিণ কোরিয়ার এসকে গ্যাসের এক প্রস্তাবের মাধ্যমে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল। তারা বিপিসিকে একটি যৌথ উদ্যোগের প্রস্তাব দিয়েছিল এবং বরাদ্দকৃত জমির জন্য বিপিসিকে ১৫ শতাংশ শেয়ার দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। সংস্থাগুলি একইসাথে এই প্রকল্পে অর্থ ও প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ করতো।
তবে ২০২০ সালের শুরুতে বিপিসি আরও দুটি প্রস্তাব পায়। ভিটল, মারুবেনি ও পাওয়ারকো কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাব এবং অন্যটি জাপানের সুমিতোমো করপোরেশন,গাইসিস করপোরেশন ও নেদারল্যান্ডসের এসএইচভি এনার্জির প্রস্তাব। এই দুটি প্রস্তাবের ক্ষেত্রেই বিপিসিকে ৩০ শতাংশ শেয়ার দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রস্তাবগুলো নিয়ে বেশ কয়েকটি বৈঠকের পর বিপিসি প্রকল্পটি ভিটল-মারুবেনি-পাওয়ারকো কনসোর্টিয়ামকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কনসোর্টিয়ামের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চেয়েছিল। চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারী জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিবকে পাঠানো এক চিঠিতে বিপিসি জানিয়েছে, এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার বিবেচনায় ভিটল-মারুবেনি-পাওয়ারকো কনসোর্টিয়ামকে অন্যদের চেয়ে বেশি সক্ষম বলে মনে করছে বিপিসি। বৈশ্বিক অঙ্গনে এলপিজি বাণিজ্য, বিপিসির সাথে মালিকানার অংশিদারত্ব,প্রকল্প সমাপ্তির প্রত্যাশিত সময়কাল এবং ব্যয়ের বিবেচনায় ভিটল-মারুবেনি-পাওয়ারকো কনসোর্টিয়ামকে অধিক সক্ষম বলে উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।দুর্বল ব্যবসায়িক অনুশীলনের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খবরের শিরোনামে আসা সংস্থাগুলো বেছে নেওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞ এবং স্টেকহোল্ডাররা। তারা আরও জানিয়েছেন, মিতসুইয়ের কনসোর্টিয়াম ভিটল-মারুবেনি-পাওয়ারকো কনসোর্টিয়ামের চেয়ে বেশি প্রতিযোগিতামূলক পোর্টফোলিও রয়েছে।
১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত মিতসুইয়ের ৬৫ টি দেশে কার্যক্রম পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে। এছাড়াও কোরিয়ান এসকে গ্যাসের ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশে এলপিজি সরবরাহের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
অন্যদিকে ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ভিটলের মাত্র ১৫ টি দেশে কার্যক্রম চলমান, প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৯ সালে। একারণেই স্টেকহোল্ডাররা এমন একটি সংস্থাকে প্রকল্পটির দায়িত্ব প্রদানের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ'র (ক্যাব) জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.শামসুল আলম বলেন,"আমরা সবসময়ই উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর দায়িত্ব বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে থাকি,এর আরেকটি উদাহরণ এটি,""আমরা কি আদর্শিক মান বজায় রাখে এমন একটি জাতি হতে পারি না?"তিনি বলেন, "এই প্রকল্পের কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যদি দুর্নীতির অভিযোগ থাকে,তবে কর্তৃপক্ষের আদর্শিক মান অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ।"এবিষয়ে জানতে চাইলে মন্Íব্য করতে অস্বীকৃতি জানান বিপিসির চেয়ারম্যান মো: আবু বকর সিদ্দিকী। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন,তারা কাগজপত্রের ভিত্তিতে এবং প্রশ্নবিদ্ধ ইতিহাস না জেনেই প্রকল্পটির দায়িত্ব দেন প্রতিষ্ঠানগুলোকে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মোঃ আনিসুর রহমান বলেন,প্রকল্পটি চুক্তি চূড়ান্ত করার সময় আমরা ভিটল ও পাওয়ারকোর বিরুদ্ধে আনীত এই অভিযোগগুলো জানতাম না। প্রতিষ্ঠান দুটির জমা দেওয়া কাগজপত্রের ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।"সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করার আগে এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এই অভিযোগগুলি বিবেচনা করবেন তারা। এদিকে ১০০ ডলারের প্রতিষ্ঠানের ৩০৫ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্পে অংশিদারত হযেছে। বিপিসির নির্বাচিত কনসোর্টিয়ামের অন্যতম শেয়ার হোল্ডার পাওয়ারকো। পোর্টফোলিওতে ঢাকা ভিত্তিক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতের শীর্ষস্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্প এবং ট্রেডিং সংস্থা হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করেছে প্রতিষ্ঠানটি, প্রতিষ্ঠানটির সিঙ্গাপুরে অফিস আছে বলেও উল্লেখ করা হয়। তবে সিঙ্গাপুরের ব্যবসায় স্বত্বাধিকার,পাবলিক অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং কর্পোরেট পরিষেবা সরবরাহকারী জাতীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসিআরএ'র সাথে তালিকায় সংস্থাটি এর প্রধান কার্যক্রম হিসেবে ব্যবস্থাপনা পরামর্শ পরিষেবা এবং বিভিন্ন পণ্যের পাইকারি বাণিজ্যের কথা উল্লেখ করেছে। প্রল্পের প্রস্তাব অনুযায়ী, ভিটল এবং পাওয়ারকো ৩০ শতাংশ শেয়ার ধরে রাখতে চেয়েছিল,এক্ষেত্রে তাদের প্রত্যেককে ৪ কোটি ৫৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার খরচ বহন করতে হবে। বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কোনও সংস্থা ব্যয় বহন না করে কোনো সংস্থার শেয়ার ধরে রাখতে পারে না। কোনো সংস্থার পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১০০ ডলার হলে, কীভাবে তারা ৪ কোটি ৫৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার খরচ বহন করবে এমন প্রশ্ন রাখেন তারা। রাজধানীর বনানীতে পাওয়ারকোর প্রধান কার্যালয়ে পরিদর্শনকালে এই প্রতিবেদনের প্রতিবেদক প্রতিষ্ঠানটির মাত্র তিনজন কর্মচারীর দেখা পান। শীর্ষ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কারও নামই বলতে পারেননি। তারা শুধু কোম্পানির চিফ অপারেটিং অফিসার হিসেবে কর্মরত এম মুরাদ হাসানের সাথে যোগাযোগ করার তথ্য দেন। কনসোর্টিয়ামে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার এবং বিনিয়োগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য করার জন্য সময় চেয়ে নেন। তিনিও প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নাম জানাতে পারেননি। এদিকে বøুমবার্গ ও রয়টার্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়,ভিটলের সুইস শাখা, ভিটল এসএ প্রতিষ্ঠানটির বাণিজ্যিক কার্যক্রমের বড় অংশ পরিচালনা করে। যুক্তরাষ্ট্র, কুরাকাও, কেইম্যান দীপপুঞ্জ, বাহামা, পর্তুগাল ও ব্রাজিলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ পাঠায় প্রতিষ্ঠানটি। ভিটল এবং এই প্রতারণার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা ভুয়া চালান তৈরি করে তাদের লেনদেনকে অর্থ প্রদানের পরামর্শ প্রদানকারী পরিষেবা এবং মার্কেট ইনটেলিজেন্সের লেনদেন হিসেবে দেখায়।ব্যাটম্যান,'টাইগার','ফিল কলিনস',ডলফিন','পোপিয়ে', এবং 'বেব'সহ একাধিক কোডনেম ব্যবহার করে যোগাযোগ করেছিলেন তারা। অ্যাপেরিও ইন্টেলিজেন্সের কর্পোরেট ইনটেলিজেন্স ও ইনভেস্টিগেশন পরিচালক জর্জ ভোলোশিন বলেন, শেল/অফশোর সংস্থাগুলোর ভুয়া পরামর্শ চুক্তি, জাল চালান, জাল ইমেল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা নতুন কিছু নয়,""গত শতাব্দীর তুলনায় এসব ব্যবসায়িক কৌশলে খুব সামান্যই পরিবর্তন এসেছে। জানা গেছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ব্রাজিলের রাষ্ট্রায়ত্ত পেট্রোব্রাস কর্মকর্তাদের ৮০ লাখ ডলারের বেশি ঘুষ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।এর বিনিময়ে ব্রাজিলিয়ান তেল সংস্থার কর্মকর্তারা ট্রেডিং হাউসটিকে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সর্বাধিক প্রস্তাবিত মূল্য সহ দরপত্র সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য দিয়েছিলেন। অর্থাৎ পেট্রোব্রাসের পণ্যগুলো ঠিক যে দামে বিক্রি হতে পারে তা আগেই জেনে যেত ভিটল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জ্বালানী বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের বৃহত্তম গভীর সমুদ্র তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) টার্মিনাল তৈরির জন্য তিনটি সংস্থার কনসোর্টিয়ামকে চুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) নিয়েছে নিশ্চয় কারো না কারো স্বার্থ হাছিলের পথেই হাঠছে বিপিসি।